বারোবাজার এখন ইতিহাস
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দুই ধারে শত শত পুকুর ও দিঘির স্বচ্ছ জলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ। ভৈরব নদীর তীরে ঐতিহাসিক মসজিদ পরিবেষ্টিত বারবাজার। ১২ জন আওলিয়ার নামানুসারে এখানকার নামকরণ করা হয়।
এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাদত খাঁয়ের নামে শুধু বারোবাজার নয় পার্শ্ববর্তী বেশকিছু গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে।
বঙ্গ বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নদীয়া দখলের পর দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তর দিকে বেশি আকৃষ্ট হন। ফলে তার বিজিত রাজ্য উত্তরদিকে প্রশস্ত হতে থাকে।
পরিশেষে সামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে যশোর ও খুলনার কিংবদন্তি তার রাজ্যভুত হয়। ওই অঞ্চলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন বাগেরহাটের হযরত খান জাহান আলী। তিনি ১৬৫৯ সালের ৩ অক্টোবর ইহলোক ত্যাগ করেন।
আত্মরক্ষার্থে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়ার দৌলতগঞ্জে প্রবেশ করেন খান জাহান আলী। সেখান থেকে বৃহত্তর যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারোবাজার অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে জনসাধারনের পানীয় জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগণিত দিঘি আর পুকুর খনন করেন। কথিত আছে, এক রাতেই এসব জলাশয় খনন করা হয়েছিল। বারোবাজারে ৮৪ একর পুকুর ও দিঘি এখনও বিদ্যমান।
এ অঞ্চলে ১৮টি দিঘির মধ্যে পীরপুকুর, গোড়ার পুকুর,সওদাগর দিঘি, সানাইদার পুকুর, সাত পীরের পুকুর, ভাই-বোনের দিঘি, আনন্দ দিঘি,গলাকাটা দিঘি,জোড়াবাংলা দিঘি, চোরাগদা দিঘি,মাতারানী দিঘি, নুনোগোলা দিঘি, কানাই দিঘি, পাঁচ পীরের দিঘি, মনোহর দিঘি, আদিনা দিঘি, শ্রীরাম রাজার দিঘি ও বেড় দিঘি উল্লেখযোগ্য।
এক সময় হযরত খানজাহান আলী বেলাট দৌলতপুরের পূর্ব দিকে বাদুগাছা গ্রামের প্রভাবশালী শ্রীরাম রাজাধীরাজের মুখোমুখি হয়ে পড়েন এবং কিটুটা বাধাগ্রস্ত হন। ফলে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে অধিক উৎসাহী হয়ে বারোবাজারে এক যুগকাল অবস্থান করেন। তার দৃঢ় মনোবল, উদারতা, দানশীলতা ও মাহনুবভতায় এলাকাবাসী মুগ্ধ হয়ে পড়েন। এলাকার অনেক অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণে ঝুঁকে পড়েন। এভাবে এক যুগ অবস্থানের পর সবকিছু এক শিষ্যের তত্ত্বাবধানে দিয়ে তিনি শেষ জীবন বাগেরহাটে অতিবাহিত করেন।
খানজাহান আলীর এক যুগ সাধনার স্থাপত্য নিদর্শন আজও রয়ে গেছে এই বারোবাজারে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নিদর্শন ৩২ গম্বুজ বিশিষ্ট সাত গাছিয়া আদিনা মসজিদ ও বারোবাজার গলাকাটা দিঘির ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। যে মসজিদটি মাত্র দুটি ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে অগণিত মসজিদ। যার অনেকগুলো ইতোমধ্যে আবিস্কার করে আংশিক সংস্কারও করা হয়েছে। এখনও অনেক মসজিদ মাটির নিচে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কথিত আছে, বহুকাল আগে এই বারোবাজার যুদ্ধে অথবা মহামারিতে জনশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর এখানে ১২ জন আওলিয়ার আগমন ঘটে এবং তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অগণিত মসজিদ, পুকুর আর দিঘি।
জলাশয়ের ঘটনাগুলো স্থানীয়রা উপলব্ধি করলেও মসজিদগুলো মাটির টিবির নিচে থাকায় এর গুরুত্ব কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। কারণ প্রতিটি জলাশয়ের পাশেই একটি করে মসজিদ অবস্থিত। আর সেই মসজিদের সিড়ি জলাশয় পর্যন্ত পাকা করা ছিল। এসব পাকা সিড়ির ওপর প্রায় ৮-১০ ফুট পর্যন্ত মাটি চাপা পড়ে মসজিদগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কয়েক বছর আগে এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে কিছু মসজিদ ও পাকা সিড়ি আবিস্কার করেন। এছাড়াও তারা কয়েকটি মসজিদ সংস্কারও করেন।
বারোবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন জানান, ইতিমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদগুলোর সংস্কার কাজ করেছেন। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে বারোবাজারে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। এটি করা হলে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে বারোবাজারের নাম।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠাণ্ডু জানান, বারোবাজারের এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের তেমন প্রচার না থাকায় মূলত পর্যটকশূন্য। এছাড়াও আবাসিক হোটেল-মোটেল না থাকায় পর্যটকদের নজর কাড়তেও ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারছে না।
সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে পর্যটকদের উৎসাহিত করলে এবং সরকারিভাবে মসজিদগুলোর শোভাবর্ধনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এটি আরও নান্দনিক ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতিক্ষণ/এডি/রানা